প্রকাশিত: Thu, May 9, 2024 1:44 PM
আপডেট: Sun, Jun 22, 2025 4:23 PM

ন্যাশনাল ব্যাংকের নৈতিকতা ও সাংবাদিকদের তারল্য সংকট!

ফারদিন ফেরদৌস : সংবাদ করে দেওয়ার বিনিময়ে সাংবাদিক কি অর্থ গ্রহণ করতে পারেন? এককথায় উত্তর হলো, না। পাশাপাশি আরেকটি প্রশ্ন আসে, সাংবাদিকরা কি বিপথে টাকা গ্রহণ করে? উত্তর হলো ঢালাওভাবে সবাই করে না, অধিকাংশই করে। শেষ প্রশ্নটি এমন, সাংবাদিকরা অবৈধ টাকা কেন গ্রহণ করে? কারণ তারা যে প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন সেই প্রতিষ্ঠান কর্মীদের যথোচিত মূল্যায়ন করে না বা মূল্য দেয় না। তাহলে যে মানুষটি পণ করে বসে আছে সাংবাদিক হবেন, অথবা সাংবাদিকদের অবস্থান ভালো হবেÑ এমন স্বপ্ন দেখতে দেখতে বুড়ো হয়ে গিয়ে অন্য কোনো কর্ম করে খাবার বয়স হারিয়ে ফেলেছে, তারা কী করবেন? বাস্তবতা হলো, প্রত্যেকটি সরকারি কর্মকর্তা বা পলিটিশানরাই জানেন নিউজ কভারেজের জন্য সাংবাদিক ডাকলে কনভেয়ান্সের নামে কিছু খরচাপাতি দিতে হয় এবং রীতিমতো সরকারি কাগজে সিগনেচার করে ওই অর্থ গ্রহণ করতে হয়। কেউ কেউ নেন না, সেটা তার বা তার হাউজের একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। হাউজ যদি কর্মীদের মূল্যায়ন করে, জীবনমানের ব্যয় অনুধাবন করে কর্মীর পর্যাপ্ত বেতন নির্ধারণ করে তাকে দাসখত দিয়ে ঠুনকো টাকা গ্রহণ না করলেও চলে। 

বাংলাদেশে প্রথম আলো বা ডেইলি স্টার ছাড়া অন্যরা খুব কমই কর্মীদের আগলে রাখতে জানে। যে সাংবাদিকের পকেট খালি, কারো সেধে দেওয়া টাকা সে ফেলতে পারবে? মুফতে পাওয়া ওই এক-দুই হাজার টাকাই? হয়তো দুঃস্থ সাংবাদিকের ওইদিনের ইনসুলিন কেনার টাকা, সন্তানের স্কুলের বেতনের টাকা, মায়ের ডায়ালাইসিসের টাকা কিংবা পরিবারের সবাই মিলে মুখে দুমুঠো নুনভাত জোগানোর টাকা। এত কথা কেন? হচ্ছে? প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারে খবর পরিবেশিত হয়েছে, নাশতার প্যাকেটের সঙ্গে সাংবাদিকদের টাকা দিলো ন্যাশনাল ব্যাংক। ওই খবর থেকে জানা যাচ্ছে, সংবাদ সম্মেলনের পর সাংবাদিকদের হাতে নাশতার যে প্যাকেট দেওয়া হয়, তার ভেতরে পাঁচ হাজার টাকা ভর্তি খাম পাওয়া যায়। বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংকের নবগঠিত পরিচালনা পর্ষদ তাদের পরিকল্পনা জানাতে সোমবার তাদের প্রধান কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করে। সেখানে ব্যাংকের নতুন চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, আগামী এক বছরের মধ্যে ন্যাশনাল ব্যাংককে দুর্বল অবস্থান থেকে সবল অবস্থানে নিয়ে যাওয়া হবে। সাংবাদিকেরা যেন ব্যাংকটি নিয়ে ইতিবাচকভাবে লেখেন এমন প্রত্যাশা করেন খলিলুর রহমান। 

সংবাদ সম্মেলন শেষে ব্যাংকটির কর্মকর্তারা সাংবাদিকদের হাতে নাশতার প্যাকেট তুলে দেন। প্যাকেটটি নেওয়ার পর দেখা যায়, তার ভেতরে পাঁচ হাজার টাকা ভর্তি খাম। নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগের পরেই সংবাদ সম্মেলন ডাকা হয়। সংবাদ সম্মেলন শেষে সাংবাদিকদের নাশতার প্যাকেটে ১০ হাজার টাকার খাম দেওয়ার নির্দেশ দেন চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান। তবে ব্যাংকটিতে টাকার (তারল্য) ঘাটতি থাকায় ১০ হাজার টাকার পরিবর্তে পাঁচ হাজার টাকার খাম দেওয়া হয়। প্রথম আলো জানাচ্ছে, এটি দেখার পর সেখানে উপস্থিত বেশ কয়েকজন সাংবাদিক নাশতার প্যাকেট ফেরত দিয়ে ব্যাংক থেকে বেরিয়ে যান। এ বিষয়ে সেখানে উপস্থিত এক সাংবাদিক বলেন, যে ব্যাংকের বিরুদ্ধে গ্রাহকের টাকা লুটপাটের অভিযোগ আছে, তারাই আবার সংবাদ প্রচারের জন্য সাংবাদিকদের অগোচরে টাকার খাম দিতে চাচ্ছে, এটি অত্যন্ত লজ্জাজনক। অগোচরে টাকার খাম দেওয়া অতি অবশ্যই লজ্জাজনক কাজ। কিন্তু এই লজ্জার অনুভূতি কারা সৃজন করেছে?

ন্যাশনাল ব্যাংক দুই দশক আগেও বাংলাদেশের লিডিং ব্যাংক ছিল। সিকদার পরিবার ব্যাংকটিতে দখলদারিত্ব কায়েমের পর এখন সেটি প্রায় নিঃস্ব হয়ে গেছে বা নিঃশেষ করে ফেলা হয়েছে। যারা ব্যক্তি বা পারিবারিক স্বার্থে একটি ব্যাংকের মূলধন, গ্রাহকদের আমানত এবং কর্মীদের রুটিরুজি খেয়ে দিতে পারে তাদের কাছে নৈতিকতা আশা করা ভুল। তাদের লজ্জা বা হায়া বলে কিছু আছে এমনটাও আমরা মনে করি না। কিন্তু সাংবাদিকরা একজোট হয়ে ওই? সংবাদ সম্মেলন কেন বর্জন করতে পারলেন না? খবরেই বলা হলো, বেশ কয়েকজন সাংবাদিক খাবারের প্যাকেট ফেরত দিয়ে চলে যান। সবাই তা পারলো না কেন? ন্যাশনাল ব্যাংকের টাকা সাধার আলাপের আগে তাই আমাদের সমস্বরে আওয়াজ তোলা উচিত সাংবাদিকের পকেটে তারল্য সংকট কেন? কেন বেপথো সওদাগর, দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ বা সরকারি হাই অফিশিয়ালরা তাচ্ছিল্যভরে বলে দিতে পারেন, দুই টাকা হলেই সাংবাদিক কেনা যায়। কেন রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভকে অন্যের গলগ্রহ হয়ে জীবনযাপন করে যেতে হয়। কেন গরুর বাজার থেকে হাশিল তুলবার মতো সুযোগ সাংবাদিকদের দেওয়া হয় এবং সেই হাশিল থেকে নিয়োগকর্তাদেরও বখড়া গ্রহণ করতে হয়? কাজেই আমাদের শেষ? কথা এটাই আলোচ্য ব্যাংকের নৈতিকতা খুঁজবার আগে আমাদের সাংবাদিকদের তারল্য সংকট যারা সৃষ্টি করে রেখেছেন, তাদের হদিস জানাটা আগে জরুরি। ফুটনোটস : টাকার অংকটা হাজারে না হয়ে লাখে হলে কি আরো বড় নিউজ হতো? নাকি বেমালুম চেপে যাওয়ার চেতনা পাওয়া যেতো? লেখক: সাংবাদিক